স্থূলতা সারা বিশ্বেই এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে পরিচিত। তাই তো মানুষ সবসময় তার ওজন কমাতে চায়, মোটা হয়ে গেলে ডায়েট করে। তবে প্রায়ইস দেখা যায়, ওজন কমাতে গিয়ে ওজন কমানো সম্ভব হয় না, বরং ওজন কিছুটা আবার বেড়ে যায়। 

ওজন কমানোর জন্য ডায়েট করলাম, ওজন কমে গেলো ৫ কেজি। তবে ডায়েট ছেড়ে দেয়ার পর আবার ওজন ৭কেজি বেড়ে যায়। অর্থাৎ ক্যালরি আমরা নেয়া ছেড়ে দিলাম, আবার পুনরায় ক্যালরি নিলাম বেশি করে।

ওজন কমানোর উপায় ডায়েট,diet ও ওজন সম্পর্কে যত ভুল ধারণা,ডায়েট করার পরও ওজন না কমার কারণ,ডায়েট করার সঠিক নিয়ম,শুধু না খেলেই কি ওজন কমে যাবে,lose Weight


এর কারণ কি?(What is the reason)

আমাদের খাওয়ার প্রবণতা সবসময়ই বেশি থাকে, কারণ ব্রেইন সবসময়ই চাবে খেয়ে ফ্যাট সঞ্চয় করতে , যাতে পরবর্তীতে বিপদের বা দুর্ভিক্ষের সময় এই শক্তি ব্যবহার করতে পারে। স্বাভাবিক একটা বৈশিষ্ট্য আমাদের বেচে থাকার জন্য। 

এখন যখন আমরা ডায়েটে থাকি, তখন খাওয়া কমিয়ে দিলে পরবর্তীতে খাবারের প্রতি আমাদের ঝোক বা প্রবণতা থাকে অনেক বেশি। তাই ডায়েট করে ওজন ৫-১০ কেজি কমানোর পরে আমাদের ব্রেইন চাবে এই কমানো ওজনকে পুনরায় বাড়িয়ে নিতে, তাই খাওয়ার প্রতি ঝোক( crave)৷ বেড়ে যায়। 

ফলে ওজন ৭-১৩ কেজি আবার বেড়ে যায়। এই বিষয়ের সাথে অনেকের অভিজ্ঞতার মিল পাওয়া যাবে। 


ব্রেইনই ঠিক করে আপনি মোটা হবেন নাকি চিকন?(Brain decides whether you will fat or not)

নতুন গবেষণায় ডায়েটের ব্যাপারটা একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। এক্ষেত্রে ব্রেইন ঠিক করে আপনি কি পরিমাণ খাবেন এবং কি পরিমাণ আপনি ডায়েট করতে পারবেন। 

দুটি ফ্যাক্টর কাজ করে, আপনি ধনী নাকি গরিব। এবং আপনি সুখে আছেন নাকি বিপদে। 


যখন,

ধনী এবং সুখে আছেন- মোটা হবেন

ধনী এবং বিপদে - মোটা

গরিব এবং সুখে- মোটা

গরিব এবং বিপদে আছেন- চিকন হবেন। 

ওজন কমানোর উপায় ডায়েট,diet ও ওজন সম্পর্কে যত ভুল ধারণা,ডায়েট করার পরও ওজন না কমার কারণ,ডায়েট করার সঠিক নিয়ম,শুধু না খেলেই কি ওজন কমে যাবে,lose Weight
ডায়েট নিয়ে সমস্যার ভুগে থাকলে ব্রেইনকে সিগন্যাল দিতে হবে যে আপনি গরিব এবং বিপদে আছেন। তাহলেই ওজন কমবে।
Health science 

এখন ধনী,গরিব,সুখ,দু:খ বলতে কি বুঝানো হচ্ছে??
একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা সহজে বুঝা যাবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিপদে পড়েই বিভিন্ন বন্যপ্রাণী থেকে বাচতে দৌড় দিতেন। অর্থাৎ দৌড় দিলে ব্রেইন বুঝবে আপনি বিপদে আছেন। তখন অ্যাডরেলানিন বাড়বে, ফ্যাট ভাঙ্গবে। আপনি চিকন হবেন। 

আর সুখে থাকলে তো ফ্যাট জমে পেট মোটা হবে। 


স্বাভাবিকভাবে যারা ধনী তাদের টাকাপয়সা আছে, তারা সব ধরনের প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট খেতে পারে। অন্যদিকে যারা গরীব তাদের সামর্থ্য কম বলে তাদের খাওয়ার প্রবণতাও কম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় ধনীরা স্থূল হবে বেশি। চিকেন, নান, গ্রিল,মিউনিস খাবারে প্রোটিন,কার্বোহাইড্রেট ও চর্বি এই তিনটির মানই বেশি। 

অন্যদিকে গরীবের ডাল,ভাত,ডিমে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট পরিমিত থাকে, ক্ষেত্রবিশেষ থাকে না। আর ফ্যাট তো থাকেই না বলতে গেলে। আবার ধনীরা দৌড়ায় কম, কায়িক পরিশ্রম করে না, শুয়ে থাকে, সুখে থাকে। ফলস্বরূপ তাদের মেদ জমে বেশি। ফলে ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ বেশি হয়। এজন্যই পূর্বে ডায়াবেটিসকে বলা হতো ধনীদের রোগ। কারণ তারা কায়িক পরিশ্রম করতো না, ফলে মোটা হতো। এবং যাদের স্থূলতা বেশি, তাদেরই ডায়াবেটিস বেশি হয়। 


এখন আপনি দৌড়ালেন, ওজন কমলো। তবে যদি সুখে থাকেন, তাহলে অতিরিক্ত খাবার খেয়ে আবার ওজন বাড়িয়ে ফেলবেন। কিন্তু যদি বিপদেও থাকেন এবং গরিবও হন তখনই শুধুমাত্র ওজন কমাতে পারেন। এজন্যই যখন শিল্প বিপ্লব হয় তখন মানুষ ধনী হওয়া শুরু করে এবং মোটা হতে থাকে। এর পূর্বে স্থূল মানুষ তেমন পাওয়া যেতো না। 


ওজন বাড়ার কারণ হিসেবে মূলত দায়ী কি?(What is the root cause of weight gain)

ওজন বাড়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বা উপমহাদেশের মানুষ ভাত খাওয়াকে দায়ী মনে করে।হ্যা, অতিরিক্ত ভাত খেলে তার ৩০-৪০% ফ্যাটে পরিণত হয়। তবে ভাত খাওয়াটা মূল সমস্যা না। কেননা, আমাদের দুই প্রজম্ম আগে বাব-দাদাদের অনেকেই অনেক বেশি ভাত খেতো। এরকমটা কিন্তু প্রায়ইস শোনা যায়। 

তাও তারা বর্তমান প্রজম্মের মতো স্থূলকায় ছিলো না, স্বাস্থ্যবান ছিলো।কারণ তারা পরিশ্রম করতো এবং junk food কম খেতো। আমরা junk হচ্ছে বেশি খাই। প্রতিনিয়ত এত চিনি গিলছি আমরা, তা কল্পনাতীত। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমাদের sleep cycle নষ্ট হওয়া। আমরা অতিরিক্ত রাত জাগি যা হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট করে। স্থূলকায় এর ভূমিকা আছে। 


সঠিক সময়ে ঘুম কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সাথে মোটা হওয়ার সম্পর্ক?(Why maintaining sleep cycle is so important) 

সচিন পান্ডা নামের একজন লেখক তার একটি বই circadian clock নামক বইতে লিখেছে আমাদের শরীর নির্দিষ্ট একটি সময়ে কিছু কিছু হরমোন সর্বোচ্চ পরিমাণ করে এবং কিছু হরমোন কমিয়ে দেয়। ঐ অনুযায়ী আমাদের শরীর তার শারীরতত্ত্বীয় ফাংশন সমপন্ন করে। 

উদাহরণস্বরূপ, সকাল ৮ টার দিকে যখন আমরা ঘুম থেকে ওঠি তখন আমাদের দেহে cortisol  বেড়ে যায়, এর কাজ হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ তখন বাড়িয়ে দেয়া যাতে ঘুম থেকেই ওঠে এনার্জি বা শক্তি পাওয়া যায় এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে। 

রাত ৯ টার দিকে আমাদের মেলাটোনিন যা ঘুমের হরমোন নামে পরিচিত, এটির পরিমাণ সর্বোচ্চ হয়। মেলাটোনিন হচ্ছে master antioxidant hormone যা দেহের সকল garbage  দূর করে। এরকম দুটি master antioxidant হচ্ছে - মেলাটোনিন ও গ্লুটাথিওন। 

দেহে সারাদিন কাজ করার পর যে ক্ষতিকর পদার্থ বা free radical তৈরি হয় তা ঘুমের সময় melatonin বেড়ে গিয়ে antioxidant হিসেবে কাজ করে দেহের ক্ষয়রোধ করে। 

সহজ কথায় সারাদিনে দেহের যা ক্ষয় হয় তা ঘুমের মাধ্যমে দূর হয়। তখন মেলাটোনিন হরমোন কাজ করে।মেলাটোনিনের পরিমাণ ৯টার দিকে সর্বোচ্চ হয় এবং তা delta sleep বা deep sleep এর কাজ করে। ফলে ঘুম ভালো হয়, কাজের দক্ষতা বা productivity বাড়বে। 

আবার আমাদের শক্তির( বায়োলজিক্যাল এনার্জি) হচ্ছে ATP যা কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে আসে। এসব মাইটোকন্ড্রিয়া সারাদিন কাজ করার পর free radical দ্বারা ক্ষয় হয়। এগুলোর ক্ষয়পূরণ করার জন্য মেলাটোনিন হরমোন গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে ঘুম দিলে মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষতপূরণ হয় এবং সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। 

কিন্তু যদি সঠিক সময়ে না ঘুমানো হয় তাহলে শরীরের যা ক্ষয় তা পূরণ হয় না। রাত জাগলে এমনটা হয়। ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া ATP তৈরি করতে পারে না। ফলে সরাদিন আপনি low energy তে ভুগবেন। ফলে যেহেতু আপনার শক্তি নেই, তাই শক্তি পাওয়ার জন্য আপনি বেশি বেশি খাবেন। ফলে মোটা হয়ে যাবেন। 

অর্থাৎ বেশি রাত জাগলে খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে এবং স্থূল হয়ে যাবেন আপনি। তাহলে ডায়েট আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। 

দেরিতে ঘুমালে ডায়াবেটিস ও বেড়ে যাবে?(Late sleep may cause diabetes) 

মেলাটোনিন এর আরেকটি কাজ হচ্ছে এটি পরিপাক বন্ধ করে দেয়(shut down the digestive system). রাতে ঘুমানোর সময় digestive system shut down৷ হয় এবং সকালে যখন ঘুম থেকে ওঠা হয় তখন পরিপাক শুরু হয় এবং energy পাওয়া যায়। মেলাটোনিন রাতে দেহকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যাস(resistance) করে যা সাধারণ। তবে সঠিক সময়ে না ঘুমালে এই ইনসুলিন রেজিস্ট্যাস হবে অন্য সময়(দিনের বেলায়) যা পরোক্ষভাবে ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেয়। 

আবার মেলাটোনিন আলোতে কাজ করতে পারে না। তাই রাতে ঘুমানোর আগে ফোনের আলো থেকে দূরে থাকা উচিত। 

ওজন কমানোর উপায় ডায়েট,diet ও ওজন সম্পর্কে যত ভুল ধারণা,ডায়েট করার পরও ওজন না কমার কারণ,ডায়েট করার সঠিক নিয়ম,শুধু না খেলেই কি ওজন কমে যাবে,lose Weight
ডায়েট সম্পর্কে সঠিক ধারণা সবকিছু একসাথে মেইনটেইন করা
স্বাস্থ্য পরামর্শ 

অতএব বুঝা যাচ্ছে,নিজের ডায়েট ঠিক রাখার জন্য রাতের ঘুম কতটা গুরুত্বপূর্ণ । কেননা এটা না করলে খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে, ফলে ওজন কমানোর পর আবার ওজন বেড়ে যাবে। 

অর্থাৎ সংক্ষেপে ডায়েট করার জন্য কি কি প্রয়োজন?(what to do to maintain a proper diet)

১. সর্বপ্রথম ঘুম ঠিক করেন, যদি সম্ভব হয় ৯-৯:৩০ এ ঘুমিয়ে পড়ার। তবে বর্তমান যুগে প্রায়ইস তা সম্ভব হয় না। তাই সর্বোচ্চ ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া

২. খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ। 

৩. ফলমূল-শাকসবজি খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা

৪. পরিমিত ব্যায়াম ও পরিশ্রম করা

৫. ফাস্ট-ফুড পরিত্যাগ (যদি ওজন কমাতে চান)

৬. সুগার বেশি যেসব খাবারে আছে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা

অতএব বুঝা গেল শুধু না খেলেই ওজন কমে যাবে না।বরং খাবারের সাথে ঘুম, ব্যায়াম, পরিশ্রম ও ইচ্ছাশক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের ডায়েট সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা থাকে তা এই আর্টিকেল সম্পূর্ণ পড়ার মাধ্যমে দূর হবে। 

ওজন কমাতে হলে শুধু একটি জিনিস নয় বরং সব বিষয় মেনে চলতে হবে। শুধু তরল জাতীয় ডায়েট, বা ক্যালরি একেবারে না গ্রহণ, লো চর্বি খাওয়া বা চর্বি একেবারে না খাওয়া, তেল বাদ দেয়া, শুধুমাত্র ব্যায়াম করা ইত্যাদি ভ্রান্ত ধারণা আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্লিপ cycle ঠিক করা তারপর খাদ্য ক্যালরি নিয়ন্ত্রণে রাখা। 

আশা করি আপনি আপনার ওজন কমাতে পারবেন