ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ এবং দিন দিন সেটি বাড়ার ভয়াবহতা? (ডায়াবেটিস ২০২৪)

 ডায়াবেটিস শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যাবে বহুমূত্র। অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস হয় তাদের মূত্রের পরিমাণ হয় অধিক বেশি। এছাড়ার মূত্র বা urine এর সাথে গ্লুকোজ ও ক্ষেত্রবিশেষ যায়। ডায়াবেটিসের প্রকারভেদের ভিন্নতার ওপর এর প্রভাব, লক্ষণ কারণের মধ্যেও ভিন্নতা দেখা যায়। বিশ্বে এই রোগটি এতই বেড়ে গিয়েছে এবং দিন দিন এতোই বাড়ছে যে এ বিষয়ে বিস্তরস্বরূপ জানা, বুঝা এবং সচেতনতা বা তদনু্যায়ী কাজ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেছে। 


ডায়াবেটিস মূলত কি?( What is diabetes) 

ডায়াবেটিস বলতে গেলে একটা বিপাকীয় সমস্যা বা metabolic syndrome যখন দেহের কোষ ইনসুলিন নিতে পারে না অথবা দেহে ইনসুলিন কম তৈরি হয়। ইনসুলিন অগ্ন্যাশয় বা pancreas এর আইলেটস অব ল্যানগারহেনস থেকে নি:সৃত একটি অন্ত:ক্ষরা হরমোন সেটি মূলত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে তা কোষের ভেতর প্রবেশ করায়। 

অর্থাৎ ইনসুলিন নি:সৃত হলে রক্তে গ্লুকোজ কমে গিয়ে তা কোষের ভিতর প্রবেশ করে। ফলে কোষে বিপাক বা metabolism হতে পারে। কোষের বৃদ্ধির জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ। 

আবার কোনো কারণে যদি রক্তে গ্লুকোজ কমে যায় তখন গ্লুকাগন ঐ অগ্ন্যাশয় থেকেই নি:সৃত হয়ে কোষে গ্লুকোজ কমিয়ে দেয় এবং রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই ভারসাম্য থাকে। তবে কোনো কারণ ইনসুলিন বিষয়ক সমস্যা তৈরি হলেই ডায়াবেটিস হয়। 


ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ- 

১. ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস- 

ডায়াবেটিস বলতে সচারাচর আমরা যা বুঝে থাকি তা ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস( diabetes mellitus). এর আবার দুটি প্রকারভেদ আছে, 

এই ডায়াবেটিস ইনসুলিন সম্বন্ধিত। অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে অথবা কোষ ইনসুলিন রেজিসটেন্স দেখালে এমন হয়। তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা ডায়াবেটিস হয়। এটি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মূত্রের মধ্যেও যেতে পারে গ্লুকোজ। 


২. ডায়াবেটিস ইনসিপিটাস 

এক্ষেত্রে ইনসুলিন সঠিকভাবেই নি:সৃত হয়, এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিকই থাকে। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হয় কিডনিতে। 

কিডনির অন্যতম কাজ হচ্ছে তা ছাকনি হিসেবে কাজ করে, কিডনি বর্জ্য পদার্থ ছেকে দেয়। এর সাথে সাথে গ্লুকোজও কিছুটা ফিল্টার হয়। এখন গ্লুকোজ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ তাই তা পুনরায় শোষণ করে নেয় কিডনির নেফ্রন। 

তবে কোনো কারণ কিডনিতে রোগ বা সমস্যা থাকে গ্লুকোজ শোষণ হতে পারে না। তখন মূত্রে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। গ্লুকোজ অসমোসিস এর মাধ্যমে পানি নিয়ে আসে। তখন মূত্রের পরিমাণ বেড়ে যায়, এটা হচ্ছে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস। 

এর দুটি প্রকারভেদ রয়েছে- 

১. কেন্দ্রীয় ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস

- এটা হবে যখন ব্রেইন থেকে ADH( Anti diuretic Hormone) বা ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোন নি:সৃত হবে না যখন ব্রেইনের পশ্চাৎ পিটুইটারিতে কোনো গন্ডগোল হবে। ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোন গ্লুকোজ পু:শোষণ হতে সাহায্য করে। তাই এটি না থাকে গ্লুকোজ শোষিত হবে না। ফলে তা মূত্র দিয়ে যাবে। তবে এর পরিমাণ ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস অপেক্ষা কম। 


২. নেফ্রোজেনিক ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস 

এক্ষেত্রে ADH ঠিকই নি:সরিত হচ্ছে তবে তা কিডনির নেফ্রনে কাজ করতে পারে না। কারণ ADH এর জন্য যে রিসেপ্টর দরকার হয় তা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত বা সমস্যাগত। তাই ADH না কাজ করতে পারায় একই ধরনের সমস্যা হয়। 


আবার ডায়াবেটিস ম্যালাইটিসের রয়েছে দুটি টাইপ। 


i) type-1 ডায়াবেটিস ম্যালাইটিস : 

এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না। ফলবসত কোষে রক্ত থেকে কোনো গ্লুকোজ প্রবেশ করতে পারে না। অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়, একে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলে। যেহেতু কোষে গ্লুকোজ যাচ্ছে না, কোষ শক্তি পাচ্ছে না। এবং অপরদিকে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গিয়ে তা মূত্র দিয়ে বের হয়। 

ii) type-2 ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস- 

এক্ষেত্রে বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন ঠিকই নি:সৃত হচ্ছে তবে কোষগুলোতে রিসেপ্টর এই ইনসিলিন নিতে পারছে না। অর্থাৎ কোষগুলো ইনসুলিনকে resist করে দিচ্ছে, একে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স(Insulin resistance) বলে। 

যারা মোটা হয় অর্থাৎ স্থূলকায় হয় তাদের ডায়াবেটিস ২ হয়ে থাকে। বা পরিবারগত অথবা জিনগত কারণে এটি হয়। 

সাধারণত ডায়াবেটিস ২ ৯০-৯৫% ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। অন্যদিকে ডায়াবেটিস ১ হয় মাত্র ৫-১০% ক্ষেত্রে। 

এজন্যই দেখা যায় বেশিরভাগ ডায়াবেটিক রোগী ঔষধ নিয়ে থাকে, কারণ তাদের ইনসুলিন তো থাকে। শুধু কোষগুলো কাজ করে না, তাই ঔষধ নিয়ে কোষের রিসেপ্টরগুলোকে ইনসুলিন নেওয়ার উপযোগী করা হয় শুধুমাত্র। এবং যাদের টাইপ-১ তারা বাইরে থেকে ইনসুলিন নিয়ে থাকে।

ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি,ডায়াবেটিস কি,কেন হয় এবং দিন দিন তা বাড়ছে কেন,ডায়াবেটিসের লক্ষণ, অপকারিতা,ভয়াবহতা এবং এটি হওয়ার কারণ, health tips, স্বাস্থ্য পরামর্শ
ডায়াবেটিস এর প্রকারভেদ
classification of diabetes


ডায়াবেটিস কেন কেন দিন দিন বাড়ছে?( Why diabetes is increasing day by day?)

ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে তা বুঝতে হলে সর্বপ্রথম বুঝতে হবে ডায়াবেটিস এর কারণ কি। ডায়াবেটিস এর বৈজ্ঞানিক কারণ তো বলা হলো, তবে আমাদের কার্যকলাপ বা দৈনন্দিন জীবনের রুটিন বা খাদ্যাভাস কিভাবে ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয় তা বুঝা দরকার। 

১. জেনেটিক কারণ - ডায়াবেটিস যাদের পরিবারগত জেনেটিক কারণ আছে, তাদের বংশগত পরাম্পরায় তা হয়ে আসতেছে। অর্থাৎ বাবা বা মার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে তাদের সন্তানের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 

২. হরমোনাল ইমবেলেন্স- ইনসুলিন ও গ্লুকাগন হরমোন তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে ডায়াবেটিস না হয়। এই হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ঘুমের cycle বা sleep cycle বিনষ্ট হলে শুধু এ হরমোন সকল হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। তাই সঠিক সময়ে ঘুম না আসলে হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে ডায়াবেটিস এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

এমনকি ক্যান্সারও বেড়ে যেতে পারে। 

৩. বেশি রাত জাগা- হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায় বেশি রাত জেগে থাকলে ডায়াবেটিস এর সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। 

৪. স্থূলতা(obesity) :  মোটা মানুষের বা যাদের ফ্যাট বেশি থাকে পেটে তাদের ডায়াবেটিস -২ এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে ঠিক কি কারণ স্থূলতা ডায়াবেটিস বাড়ায় তা এখনো গবেষণারত। 

৫. খাদ্যাভাস ( food habit): যেহেতু স্থূলতা ডায়াবেটিস বাড়ায় এবং আমাদের খাদ্যাভাসের ওপর এটা অনেকটাই আমাদের মোটা, চিকন হওয়া নির্ভর করে। তাই অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ায়। 

6. উচ্চ রক্তচাপ বা hypertension : এরাও ডায়াবেটিসের ঝুকিতে থাকে। 

 7. polycystic ovary syndrome: এই রোগটি অনেক মেয়েদের কমন একটি রোগ। বলা হয় মেয়েদের মধ্যে জেনিট্যাল সিস্টেমের সবচেয়ে কমন হচ্ছে এই রোগ। এটি ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। 


ডায়াবেটিস হলে সমস্যা কোথায়? বা এর ভয়াবহতা কি?

ডায়াবেটিস হলে ব্যাক্তির রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকবে, কোষে কম। ফলে কোষ কাজ করার জন্য যে শক্তি দরকার তা পাবে না। 

তাহলে ব্রেনের কোষ শক্তি না পায় তাহলে কি হবে বুঝতেই পারা যাচ্ছে। 

স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। 

ডায়াবেটিস হলে ইনসুলিন নি:সৃত হয় না বা কোষ ইনসুলিন নেয় না। ফলে যেসব কোষে ফ্যাট থাকে, অর্থাৎ adipose tissue তে হরমোন সেনসেটিভ লাইপেজ উদ্দীপিত হয় এবং ফ্যাট ভেঙ্গে ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারল হয়। তখন রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। তাই ডায়াবেটিক রোগীদের হার্ট অ্যাটাক বেশি হয়ে থাকে।

আবার লিভার তখন ট্রাইগ্লিসারাইড এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ট্রাইগ্লিসারাইডেমিয়া হতে পারে।

ডায়াবেটিক রোগীদের মূত্র দিয়ে গ্লুকোজ যায়, তখন অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। তৃষ্ণা বেশি লাগে। খেতেও বেশি ইচ্ছে হয়। 

ডায়াবেটিস এর লক্ষণ(symptoms of diabetes)

ডায়াবেটিস হলে বেশি পানির তৃষ্ণা পায়, মূত্র বার বার আসে, মূত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, খিদে লাগে, ঘা শুকাতে দেরি হয়। 

এগুলাই প্রধান লক্ষণ যা দেখে বুঝা যাবে যে ডায়াবেটিস হয়েছে একজন ব্যক্তির

ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি,ডায়াবেটিস কি,কেন হয় এবং দিন দিন তা বাড়ছে কেন,ডায়াবেটিসের লক্ষণ, অপকারিতা,ভয়াবহতা এবং এটি হওয়ার কারণ
ডায়াবেটিস এর কারণ, লক্ষণ (Diabetes)
Health tips


তাহলে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে দিন দিন?

এর কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের লাইফস্টাইল পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

পূর্বে মানুষ যেখানে ৯-১০ টার দিকে ঘুমোতো সেখানে মানুষ এখন ১২ টা বাজলে মনে করে রাত সবে শুরু। ফলে স্লিপ cycle নষ্ট হয়ে হরমোনাল imbalance ডায়াবেটিস এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিস একটি বিপাকীয় সমস্যা(metabolic syndrome অথবা endocrine disease). যেকোনো endocrine disease এর সাথে সঠিক সময়ে ঘুমের গুরুত্ব আছে। 

আবার, ফ্যাট জাতীয় খাবার অতিরিক্ত খাওয়ার রুটিনে বর্তমান যুগ ধাবিত হচ্ছে। ব্যায়াম(exercise) করার জন্য পরিমিত জায়গা নেই। নেই খেলার জন্য জায়গা। মোবাইলকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার মানুষ খেলাধুলো থেকেও বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। 

অন্যদিকে এ যুগের মানুষ সিগারেট বেশি খায়। পরোক্ষভাবে এটাও প্রভাব ফেলে। 



Post a Comment

0 Comments